রাজশাহী রবিবার, ২৪শে আগস্ট ২০২৫, ১০ই ভাদ্র ১৪৩২


একজন পেপার বিক্রেতার স্বপ্ন সফলতার গল্প


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:০৭

আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২৫ ১৭:৫৫

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা থেকে পূর্বদিকে ছয় থেকে সাত কিলো নানাইচের মোড় থেকে সামান্য এগুলেই দেখা যায় ৫ নম্বর ওয়ার্ড নানাইচ নামে ছোট্ট একটি গ্রাম।এই গ্রামের আশেপাশে প্রকৃতির আশীর্বাদে গড়ে উঠেছে শস্য ভান্ডার।

ঘুম থেকে উঠেই শিশির ভেজা ভোরের মেঠো পথ পেরিয়ে প্রতিদিন খবরের কাগজ সংগ্রহের পিছনে ছুটতে হয় তাকে। এসএসসি পাসের আগে বাবা রেজাউল করিম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। সংসারের সকল দায়িত্ব কাধের উপর পড়ে গেলে, লেখাপড়া খুব বেশিদূর এগুতে না পারলেও গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়া ছোট্ট ছেলেটির চোখে খেলা করতো অনেক স্বপ্ন।

বর্তমান সময়ে যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে একরকম অস্থিরতা। এই অস্থিরতার অনেকটা লাঘবের উদ্দেশ্যেই প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা আর একটু বিনোদন মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেই একদিন তিনি হয়ে গেলেন পেপার বিক্রেতা। বলছিলাম পেপার বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলমের কথা।


জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর। তার আগে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজ ও আগামীকাল পত্রিকার বোনাস ফ্রম জাহিদ কামাল পাতায় পোষ্টাকার্ডে লেখা পাঠাতাম। সেখানে আমার লেখাগুলো প্রকাশ পেলে দিন দিন আমার আগ্রহটাও বেড়ে যেতে লাগলো। একদিন আমাদের প্রতিবেশী পেপার বিক্রেতা বড় ভাইকে বললাম ভাই আমিও কি পারি আপনাদের সাথে কাজ করতে। তিনি বললেন কেন নয়, যা বলা তাই কাজ। তার পর থেকেই দৈনিকের সাথে জড়িয়ে যাই।


জাহাঙ্গীর আলমের ভাষায়, পেপার পত্রিকা বিক্রি করাটা আমার কাছে একটি সেবামূলক কাজ বলেই মনে হয়। সংসার ছেড়ে আমাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হতে হয়। মায়ের মুঠোফোন থেকে কোলের ছোট বাবুটা বলে বাবা, তুমি কোথায়? আমার জন্য একটা চিপস এনো চকলেট এনো কিন্তু..! পেপার-পত্রিকা বিক্রয়ের কাজে সারা দিন বাহিরে থাকায় তখন এনে দিতে পারি না। রাতের বেলা যখন ঘরে ফিরি প্রায় সময়ই ছেলেটির এমন বায়না মান-অভিমান আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। সমাজে বিত্ত-বৈভবের মাঝে জন্ম গ্রহণ না করায় সংসার চালাতে জীবিকা নির্বাহে অর্থ সংগ্রহের জন্য আমাকে এ পেশা বেছে নিতে হয়েছে।


তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই বলুন না কেন আমার মনে হয় এ পেশাটি একটি সেবামূলক কাজ। এতেই আমার সন্তুষ্টি এতেই আমি আত্মতৃপ্তি বোধ করি। যেমন দেখুন, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকুরীজীবী থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকেন। সারাদিন কর্মব্যস্ততায় মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠেন তখন আমার বিলি করা এই পেপার পত্রিকাগুলো পড়ে কিছুটা হলেও তারা স্বস্তির বোধ করেন।


সাইকেলের প্যাডেল চাপিয়ে সারা বিশ্বের ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার পান্ডুলিপি ঘাড়ে নিয়ে আমরা ছুটে যাই পাঠকের কাছে। এখানেই আমার তৃপ্তি এখানেই আমি সুখ খুঁজে পাই।
কথার ফাঁকে ফাঁকে জাহাঙ্গীর আলম আবেগ ভরা কন্ঠে বললেন, তবুও আমরা হকার। সমাজে যারা কাগজ বিক্রি করেন তাদেরকে হকার বলে ডাকেন অনেকেই। এই ভাষাটি শুনতে দৃষ্টিকটু মনে হলেও আমি মনে করি যে যাই বলুক না কেন আমার কাজ আমাকে চালিয়ে যেতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে অনেক দূর, অনেক পথ।


তিনি আরো বলেন, করোনার মহামারীতে সারাবিশ্বে চলছে একরকম অস্থিরতা। মানুষ হয়েছে গৃহবন্দী। যদিও এখন শহরে লকডাউন নেই কিন্তু লকডাউনের কালিমার ছাপ পড়েছে আমাদের (পেপার শিল্পে) ব্যবসায়। দৈনিক খবরের কাগজের পাতায় করোনার জীবাণু থাকার ভয়ে অনেকেই পেপার কেনা বাদ দিয়েছেন। আগে যেখানে দিনে ৫শ কপি পত্রিকা বিক্রি করতাম এখন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। এভাবে চলতে থাকলে খাবো কি বলুন। আমরাও তো মানুষ, ঘরে বউ বাচ্চা আছে সংসার আছে।


তবুও থেমে নেই জাহাঙ্গীর আলম। নম্র-ভদ্র এই ছেলেটির আচরণে ছোট-বড় প্রায় সকলেই জাহাঙ্গীর ভাই বলে সম্বোধন করেন। চিঠি আদান প্রদানে তার রয়েছে একটি কুরিয়ার সার্ভিস। সেখানেও তার সফলতা শতভাগ বলা যায়।
শুধু তাই নয় এই সফলতার ছোঁয়ায় তিনি এখন ধামইরহাট উপজেলা প্রেসক্লাবের সম্মানিত উপদেষ্টার পদটিকে অলংকৃত করেছেন।

 আরপি/ এআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top