রাজশাহী সোমবার, ১১ই আগস্ট ২০২৫, ২৮শে শ্রাবণ ১৪৩২


হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা: সেবার মানে তীব্র অসন্তোষ


প্রকাশিত:
২৫ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৪০

আপডেট:
১১ আগস্ট ২০২৫ ১৫:২৩

 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ১৫ দিনেও কোনো চিকিৎসকের দেখা পাননি। করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতি বেলার খাবারও কিনে খেতে হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।

সুস্থ হয়েছেন কিনা জানতে পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দিনের পর দিন। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী কোভিড-১৯ রোগীর পরীক্ষার ফল পরপর দু’বার নেগেটিভ হলেই তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা। কিন্তু একবার পরীক্ষা করেও অনেক রোগী ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

এসব হাসপাতালে চিকিৎসা থেকে শুরু করে খাবার দেয়া পর্যন্ত কোথাও সেবার মনোভাব পাওয়া যায়নি। করোনা আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজন পেশাজীবী যুগান্তরকে তাদের বিচিত্র ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন।

তারা অভিযোগ করেন, এক সময় কুষ্ঠ রোগীদের যেভাবে সমাজ পরিত্যাগ করত, অনেকটা সে রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। তারা বলেন, এসব হাসপাতালে সেবার মানের ঘাটতি প্রকট।
ঊর্ধ্বতনদের নজরদারি নেই বললেই চলে। এদিকে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ডেডিকেটেড বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিনামূল্যে সেবা দেয়ার কথা বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

বাংলাদেশের খবরের সাংবাদিক এমদাদুল হক বৃহস্পতিবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম দিন চিকিৎসকরা এসে তাদের দেখেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যান।

কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো চিকিৎসক দেখতে আসেননি। তবে কোনো সমস্যায় ফোন করলে তারা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালটি সরকার কোভিড-ডেডিকেটেড ঘোষণা করলেও সেখানকার চিকিৎসার মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। তিনবেলার খাবারও হাসপাতাল থেকে কিনে খেতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল ইসলাম রাতে যুগান্তরকে বলেন, করোনা চিকিৎসায় যেসব বেসরকারি হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার কথা।

এ বিষয়ে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তারা ফোন ধরেননি।
এমদাদুল হক জানান, মার্চ মাসের ২৮ তারিখ থেকে তিনি জ্বর ও কাশিতে ভুগছিলেন। পরিচিত এক চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু জ্বর ছাড়ছিল না। ওই চিকিৎসকের পরামর্শে করোনা টেস্ট করার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু আইইডিসিআরের হটলাইনে অসংখ্যবার চেষ্টার পরও যোগাযোগ করতে পারেননি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা ও এক্স-রে করেন। চিকিৎসক মৌসুমি রোগ বলে কিছু ওষুধ দেন।
পরে আইইডিসিআরে কর্মরত পরিচিত আরেক চিকিৎসক ডা. সাদিয়ার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে করোনা টেস্টের নমুনা দিয়ে আসেন। ১০ এপ্রিল ঢাকার সিভিল সার্জন অফিস থেকে একজন ফোন করে করোনা পজিটিভ বলে জানান।

এর কিছুক্ষণ পরই শাহজাহানপুর থানা থেকে ফোন করে বাসার ঠিকানা নেয়। পুলিশ এসে বাসা লকডাউন করে দিয়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসক ডা. হোসেন খান খোকন চিকিৎসা নিয়েছেন রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে প্রথমে হাসপাতালে এসে। আর পরে সমস্যা হয় সুস্থতার পরীক্ষা করানোর সময়।
টানা তিন দিন বলেও হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অনেকে নমুনা পরীক্ষার তালিকায় তাদের নাম সংযুক্ত করতে পারেনি। আবার তালিকায় নাম সংযুক্ত হলেও নমুনা নিতে আর পরীক্ষার ফল আসতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়।
দিনের মধ্যে একবার যে কোনো সময় একজন চিকিৎসক এলেও তিনি অনেক দূর থেকে কথা বলে চলে যেতেন। খাবার দেয়া হতো ওয়ার্ডের বাইরে। খাবার নেয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা দিলে হুড়োহুড়ি লেগে যেত।

রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট যুগান্তরকে বলেন, করোনা শনাক্তের পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টানা ১৫ দিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।
এই দীর্ঘ সময়ে কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। কোনো চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেননি, এমনকি কোনো নার্স এসেও খোঁজ নেননি। দরজার বাইরে খাবার দিয়ে গেছেন। নিজেরা গিয়ে সেই খাবার আনতেন।

এই অর্ধমাসে একটিবারের জন্য বিছানাপত্র পরিবর্তন করতে কেউ আসেননি। পরিষ্কার করা হয়নি রোগীদের থাকার কক্ষটি পর্যন্ত। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই টেকনোলজিস্ট বলেন, তিনি চিকিৎসাসেবার একজন কর্মী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হয়েও ন্যূনতম কোনো চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালে শুধু বাসা থেকে আলাদা থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী ঘটছে সে বিষয়ে সন্দিহান।

যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহাদাত হোসেন তার চিকিৎসার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, গত মাসের শেষদিকে একটু জ্বর আসে। খুব সামান্যই তাপমাত্রা ছিল। একটি প্যারাসিটামল খাওয়ার পর এক রাতেই জ্বর সেরে যায়। এরপর তিনি পেশাগত দায়িত্বও পালন করেছেন।

কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে বাড়িতে তার শ্বশুর ব্যাপক জ্বর ও মাথাব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার পর নিজেও পরীক্ষা করান। তার কোনো উপসর্গ না থাকলেও তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানতে পারেন।

এরপর তার শ্বশুরসহ পুরো পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয়েছেন। শাহাদাত হোসেন বলেছেন, হাসপাতালে ভর্তির পর তার মনে হয়েছে জীবনে এতটা অসহায় কোনোদিন বোধ করেননি। তিনি বলছেন, করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ এটি জানার পর শুরুতে তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
সহকর্মীদের সহায়তায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। তার ভাষায়, হাসপাতালে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে নয় দিন পার করেছি আমরা। ওখানে মনে হয়েছে রোগীরা একেবারে অভিভাবকহীন। দেখতাম চোখের সামনে রোগী মারা যাচ্ছে। লাশ ওয়ার্ডেই পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টায় একজন চিকিৎসক আসতেন। অনেক দূর থেকে কথা বলে চলে যেতেন। এমনও হয়েছে যে, নার্স আসেনি বলে একবার সকালের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া হয়নি। একবারের জন্যও চিকিৎসক আসেনি এমন দিনও গেছে। তিনি যে ওয়ার্ডে ছিলেন সেখানে একশ’র মতো রোগী ছিল। এত রোগীর জন্য মাত্র তিনটি টয়লেট, তিনটি গোসলখানা।

প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংবাদকর্মী ছিলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ভিডিওগ্রাফার আশিকুর রহমান রাজ। তিনি বলছেন, শনাক্ত হওয়ার পর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে যান। শুরুতেই তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কারণ সেখানে সবাই পিপিই পরে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।

তাকে একজন ওয়ার্ডবয় একটা পলিথিন ব্যাগে বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টয়লেট টিস্যু আর একটা সাবান দেয়। এগুলো দিয়ে ওয়ার্ডবয় চলে গেল। নিজের বিছানাও নিজে গুছিয়ে নিতে হয়। তিনি বলছিলেন, প্রথম দিন তার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে কেউ আসেনি।

চিকিৎসকদের ফোন করে তিনি সেটি জানানোর পর সাড়ে ৪টার দিকে তার জন্য একটি বক্সে করে খাবার এসেছিল। কোনো প্লেট দেয়া হতো না। সেখানে পানি গরম করা থেকে শুরু করে সবকিছুই নিজেকে করে নিতে হয়েছে। অসুস্থ লোকদের গিয়ে সেই খাবার নিয়ে আসতে হতো।

ওয়ার্ডে একজন নতুন বয়স্ক রোগী এসেছিলেন। তিনি এ তথ্যটা জানতেন না। তিনি এক রাত ও পরের সকাল না খেয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, এক সময় কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীদের যেভাবে সমাজ পরিত্যাগ করত যেন সে রকম এক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের সময় পার করতে হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো কোনো হাসপাতালে কিছু সমস্যা ছিল, সেগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের মনোবল চাঙ্গা করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা ভবিষ্যতে আর হবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

 

আরপি/ এআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top