রাজশাহী মঙ্গলবার, ১৩ই মে ২০২৫, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩২


জনদুর্ভোগ নাকি ধর্মঘট


প্রকাশিত:
১৫ নভেম্বর ২০২১ ০৫:২৮

আপডেট:
১৫ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৩০

ফাইল ছবি

করোনা মহামারির প্রভাবে প্রায় দুই বছরে জনদুর্ভোগ চরমে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে সরে মানুষ এখন মানসিক ও সামাজিক কাঠামো থেকে ছিঁটকে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের উপর করোনা ‘পশ্চাৎদেশে বিষফোঁড়া’। আয় কমে গিয়ে মানুষ এক ধরণের ট্রমার মধ্যে বাস করছে। এই সময়ে ক্রমাগত বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। হুমকিতে পড়েছে গরিব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা।

করোনায় ৬৬ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। আর ৩৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে ২০১৮ সালে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আর বর্তমানে ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি।

মাত্র এই ৩ বছরেই প্রায় পোনে ৩ কোটি বেকারত্ব বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশে দাড়াতে পারে। করোনার জন্য এই সংখ্যায় পৌঁছাতে হয়ত কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে না। দ্রুতই এই সংখ্যা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেকারত্ব বাড়লেও সরকারের কোন উদ্যোগ নিয়ে দেখা যায়নি। বরং দেখে গেলে উল্টোটা। বেকারত্ত¦কে কাজে লাগিয়ে সরকার রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত।

কথা প্রসঙ্গে ২০১৮ সালের খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ১,১৬৬ পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ১৩,৭৮,০০০টি অর্থ্যাৎ প্রতি পদের জন্য ১,১৮২ জন আবেদন করে। সেই আবেদনে প্রতিজনের ১১২ টা ফি ধরেসরকারের লাভ হয়েছে ১৫ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। কিন্তু এ বেকারত্বের সংখ্যা এতটাই বিস্ফোরণ হয়েছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্ম কমিশন পিএসসির ৪৩ তম বিসিএসে আবেদন জমা পড়ে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ টি; যা রেকর্ড পরিমাণ। আবেদন ফি ধরা হয় ৭০০ টাকা। এই বেকারত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে সরকার আয় করে (৭০০ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০) টাকা।এতে সহজেই অনুমেয় দেশের বেকারত্ব কতোটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

করোনায় মানুষ ঘরে বন্ধ থাকলেও। মুনাফাখোর ও সুবিধাবাদীরা বসে নেই। বন্ধ নেই কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের লুটপাট। সরকার তাতে সমাধান না করে ঘি ঢেলেছে। ক’দিন ধরে টক অব দ্যা টাউন হয়ে আছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। দু-এক টাকা নয় একেবারে ১৫ টাকা! এতে সরকারের দাবি, গত সাড়ে ৫ মাসে ডিজেলের জন্য বিপিসি'র প্রায় ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। কিন্তু ৫ মাসে ১ হাজার ১৪৭ কোটি লোকসান হলে, তার আগে বিপিসি অনেক লাভও করেছে।

সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার বেশি। ট্যাক্স-ভ্যাটের বাইরে যা শুধুই মুনাফা। ট্যাক্স-ভ্যাট তো নির্ধারিত। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট থেকে প্রতিবছর ৯-১০ হাজার কোটি টাকা পায়। সরকারের সব রাজস্ব আয়ের মতো এই টাকাও কেন্দ্রীয় কোষাগারে চলে যায়। কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে টাকা গেলো কোথায়! হ্যাঁ, আপনি বাড়ি থেকে বের হলে যে রাস্তায় চলছেন সেটার উন্নয়ন আবার রাস্তার পাশে হলুদ বাতির যে বিল আসে সেই বিল যায় কোষাগার থেকে!

মোদ্দাকথা হলো বিপিসি কবে কত টাকা লাভ-লোকসান করেছে, প্রতিবছর কোষাগারে কত টাকা দিয়েছে, সরকার সেটা জানে। তবে মুনাফার ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা কোষাগারে যাওয়ার পর কোথায় ব্যয় হয়েছে, সেটি সরকার জানে না। ৭ বছর আগে সরকার জ্বালানি খাতে বছরে ৩-৭ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে আবারও দিতে হতে পারে। এ কথা ভেবে সরকার এই টাকা একটা জরুরি ফান্ড হিসেবে রেখে দিতে পারতো। এই সময়ে দেশে মানুষের জন্য কোষাগার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে পারে না কি? আসলে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব। একইসাথে জবাবদিহিতা না থাকলে যা হয়।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশে ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৬৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ডিজেল/কেরোসিনের মূল্য অপরিবর্তিত ছিল।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকায় সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেলের ক্ষেত্রে বিপিসি লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ডিজেলে চলতি বছরের জুন মাসে লিটার প্রতি ২.৯৭ টাকা, জুলাই মাসে ৩.৭০ টাকা, আগস্ট মাসে ১.৫৮ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবর মাসে ১৩.০১ টাকা বিপিসির লোকসান হয়।

সাড়ে পাঁচ মাসে সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেলের ক্ষেত্রে বিপিসির মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১৪৭.৬০ কোটি টাকা। যা সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করতে হবে। তাছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রায় ৩৩ হাজার ৭৩৪.৭৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গ্রহণ করেছে। এই তেলের মূল্য বাড়ানোর জন্য ধর্মঘাট করছে বাস, ট্রাক, সিএজিসহ যাবতীয় জ¦ালানী- গ্যাস চালিত মালিক-শ্রমিকরা। বাসভাড়া যে বাড়বেই এটা মালিকরাও জানেন, তারপরও সারাদেশকে অচল করে দেওয়া কেন? এটা আসলেই বার্গেইন পাওয়ার বাড়ানোর কৌশল। ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ ভাগ, ভাড়াও বাড়বে ২৩ ভাগ। এটা জানেন মালিকরা। কিন্তু তারা চান ৫০ ভাগ বাড়াতে।

আচ্ছা দেখেন, এই যে গত কয়েকদিন আগে ৩ দিন ধরে বাস ধর্মঘট চললো, রাস্তাঘাট বন্ধ, বাস বন্ধ। কারণ তেলের দাম বেড়ে গেছে। তাদের দাবি কি? তেলের দাম কমাতে হবে। না কমালে রাস্তায় আর গাড়ি-ঘোড়া আর চলবেনা। তাহলে এখন তাদের কি করতে হবে? এবার তাদের মিটিং ডাকতে হবে, ডাকলেন। যারা দাম বাড়ালেন তারাও আসলেন আবার যারা কমানোর দাবি করলেন তারাও আসলেন। এখন সিদ্ধান্ত হলো কি! তেলের দাম কমানো যাবে না। কারণ তেলের দাম কমালে আমার লস বাড়ালে আপনার লস। তাহলে কি করবেন এবার ভাড়া বাড়িয়ে দিন । দিলেন ভাড়া বাড়িয়ে। এখন কথা হল দাবি আপনার বৈঠক আপনার। শেষে বাকি থাকে কে? সাধারণ জনগণ।

এখানে জনসাধারণ কোথা থেকে আসল? তাদের কেন এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে? ভাড়া বাড়ালেন ভালো কথা কিন্তু এটা কি ভেবেছেন যে আপনার ভাড়া বাড়ানোর কারণে একটা হতদরিদ্র পরিবার কি করে চলবে! যেখানে ৫ টাকা ৫ টাকা ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাওয়া আসা করতেন, সেখানে লাগবে ১০ টাকা ১০ টাকা ২০ টাকা। তার মানে দাড়ালো ডাবল টাকা খরচ করতে হচ্ছে এই গরীব পরিবারের। আর বড়লোকরা বড়লোকই হন। মরে কে সেই হতদরিদ্র। কারণ তার কেউ নাই। প্রত্যেক মিটিং এ বসলে তাদের নিজ স্বার্থ হাসিল ঠিকই হয় কিন্তু এর মাঝে মরে কে? সাধারণ দিনমজুর।

এবার দেখেন কিভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত ফেলতে হয়। এখানে শর্তারোপ করলো সিএনজি চালিত গাড়িতে ভাড়া বাড়ানো যাবেনা। একটা সাধারণ মানুষ কি করে বুঝবে যে কোনটা সিএনজি চালিত আর কোনটা ডিজেল চালিত গাড়ি? এখানেও গাড়ি চালক আর পাসেঞ্জারের মধ্যে মারামারির রাস্তা করে দিলেন। আবার দেখেন এমনিতেই দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। এরপরেও যদি আবার দাম বাড়ে জনগণ কোথায় যাবে? কথায় আছে না, "মরার ওপর খাড়ার ঘা" ব্যাপার ঠিক তাই । আসলে এদের দেখার কেও নাই। সব নিজ নিজ দাবি, স্বার্থ হাসিল করতে ব্যস্ত। কিন্তু কেন? আসলে তাদের মূল লক্ষ্য একটায়। মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়।

আসলে সরকার বা পরিবহন মালিক কারো কাছেই সাধারণ মানুষের কোনো মূল্যই নেই। ওবায়দুল কাদের যদিও একটা নামেমাত্র আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু সে আহবান কানে তোলেনি মালিকরা। সেটার হয়তো আভ্যান্তরীন কোনো কারণ থাকতে পারে সেটা জনগণ অনেকাংশেই বোঝেন।পরিবহন মালিকরা যা করছেন, তা যদি বিরোধী দল করতেন! তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াত? এতক্ষণে হাজার হাজার মামলা আর দেশজুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়ে যেত। বাটি চালান করে ঘর থেকে বের করা হতো।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনাকালে অধিকাংশ মানুষের জীবনেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিগত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বারবার লকডাউনে সীমিত আয়ের মানুষের একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিশাল শ্রেণির কর্মক্ষম মানুষ। এর মধ্যে নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার।করোনা থেকে দেশ যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে তখন তেল, চিনি, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টয়লেট টিস্যুসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু-হু করে বেড়ে গেছে।

দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দুমুঠো অন্ন জোগাড় করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। শুধু যে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। আসলে এটা কোনো নায্য দাবি নয় বরং ধর্মঘাটের নামে মানুষের দুর্ভোগের সৃষ্টি করা আর তাদের নিজ দাবি আদায়ের লক্ষে সাধারণ মানুষ করছে জিম্মি। এর থেকে কখন রেহায় পাবে জন-সাধারণ? তাহলে আমরা কি দেশের সাবেক নাগরিক!

লেখক, 
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ ও দফতর সম্পাদক, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ)।

 

আরপি/ এমএএইচ-০৭



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top