সবুজ চত্বরজুড়ে বিষাদের ছায়া
কলেজ ক্যাম্পাস নয়, এ যেনো কোনো একটা পার্ক। আনন্দের সাথে বিদ্যা চর্চা। সবকিছুই রয়েছে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা রাজশাহী কলেজে। করোনা মহামারির কারণে প্রায় বছর হতে চললো ক্যাম্পাস বন্ধ।
নেই শিক্ষার্থীদের তেমন আনাগোনা। মাঠের সবুজ ঘাস আর তরুলতাগুলো যেনো তরতরিয়ে বাড়ছে। ফুলে ফলে ভরে গেছে ক্যাম্পাস।

হয়তো অচিরেই কেটে যাবে মহামারি। প্রাণ ফিরে পাবে কলেজ। ফের জমবে হৈ-হুল্লোড়। এসব কিছুই ছিলো প্রত্যাশিত। এতো কিছুর মাঝে এলো একটি খবর ‘বিদায়’।
ক্যাম্পাস থেকে বিদ্যায় নিচ্ছেন পরিবর্তনের কারিগর অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান। হবিবুর রহমান রাজশাহী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার নেন ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট। আগামীকাল বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) তার শেষ কর্মদিবস। কর্মময় জীবনের ইতি টানছেন গুণি এই মানুষটি পেছনে ফেলে যাচ্ছেন তার কীর্তি।

গত কয়েকদিন ধরেই বিষাদ ভর করেছে রাজশাহী কলেজে। কলেজ আঙিনাজুড়ে তৈরী হয়েছে অসীম শূণ্যতা। সবুজ চত্বরে ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু যেনো ঝরে পড়ছে বিষাদ হয়ে।
এইতো কদিন আগেই কাজল পুকুরে থরে থরে ফুটেছিলো পদ্ম। এক বুক পানিতে নেমে শিশুর মত পদ্ম আলিঙ্গন করছিলেন অধ্যক্ষ। প্রিয় হারানোর শোকে হয়তো শুকিয়ে গেছে শতদল। পাতা ঝড়িয়েছে বিরলবৃক্ষ।
প্রায় প্রতি দিনই অধ্যক্ষকে বিদায় জানাচ্ছেন কলেজের কোন না কোন বিভাগ। সকাল থেকে রাত অব্দি চলছে এই আয়োজন। শিক্ষকদের আবেগঘন বক্তব্যে ভারি হচ্ছে চারপাশ। ভাষা হারিয়ে ফেলছেন প্রত্যেকেই।
সূত্র জানাচ্ছে, প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমানের জন্ম ১৯৬২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। বরেন্দ্র জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর মেহেরপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মকবুল হোসেন। মায়ের নাম সাইকুল বিবি। অজো পাড়াগাঁয়ের একান্নবর্তী পরিবার থেকে উঠে এসেছেন এই রত্ন। আলোকিত করেছেন দেশ।

সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে ঘর বেঁধেছেন অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান। ছেলে আরাফাত রহমান ও মেয়ে আফরিন রহমানকে নিয়ে তাদের পরিপাটি সংসার। তবে মায়ার এই সংসারে বাঁধা পড়েননি ‘মহানায়ক’।
২৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং আড়াইশো শিক্ষক নিয়ে তার রয়েছে ‘দায়িত্বের সংসার’। সেই সংসারই তার ধ্যান-জ্ঞান ছিলো এতোদিন। এবার সেই সংসারের সাথে ছিন্ন হচ্ছে মায়ার বাঁধন। বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে অবসরজনিত ছুটিতে যাচ্ছেন তিনি।
কেবল প্রশাসনিক নয়, শিক্ষক হিসেবেও শ্রেণিকক্ষে সরব ছিলেন অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান। নিজেই এই দুই সত্ত্বাকে কখনো আলাদা করে দেখেননি তিনি। কেবল প্রশাসকই নয়, শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে তিনি ভাই-বন্ধু, আপনজন। আর এ জনই হয়তো তিনি অন্যমানুষ, অন্যজীবন ছোঁয়া। আর এ জন্যই তার বিদায় বেলায় এতো বিষাদ।
জানা গেছে, অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমানের কৈশর-শৈশব কেটেছে নিজ গাঁয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখাও করেছেন গ্রামের বিদ্যালয়ে। গোমস্তাপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে তিনি এসএসসি পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে।
এরপর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহীর গভ. নিউ ডিগ্রি কলেজে। এখান থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ১৯৭৯ সালে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক এবং পরের বছর প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর শিক্ষকতায় কাটিয়েছেন অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান। তিনি ১৯৮৯ সালের ৫ নভেম্বর দিনাজপুরের ফুলবাড়ি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বদলি হয়ে আসেন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে।
এরপর সহকারী অধ্যাপক পদে তিনিপদন্নোতি পান ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে হবিবুর রহমান জয়পুরহাট সরকারী কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ এবং রাজশাহী কলেজে দায়িত্বপালন করেন।
রাজশাহী কলেজে দায়িত্বপালনকালীন ২০০৫ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদন্নোতি পান। এখানে থেকেই ২০০৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক হিসেবে পদন্নোতি পান তিনি।
এরপর বদলি হন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে। সেখান থেকে বদলি হয়ে ২০০৯ সালের ৫ জুলাই উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন রাজশাহী কলেজে । ২০১৪ সালের ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এই পদে দায়িত্বপালন করেন তিনি। তার নেতৃত্বে টানা চারবার করে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেরা কলেজের খেতাব অর্জন করেছে রাজশাহী কলেজ। দেশের একমাত্র মডেল কলেজও এখন এটি।
আরপি/ এমএএইচ

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: