রাজশাহী সোমবার, ৫ই মে ২০২৫, ২২শে বৈশাখ ১৪৩২

নানা পন্থায় এলাকা ছাড়ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ, বাড়ছে ঝুঁকি


প্রকাশিত:
৩১ মে ২০২১ ১৮:৫০

আপডেট:
৩১ মে ২০২১ ১৮:৫২

ছবি: সংগৃহীত

নানা পন্থায় নিজ এলাকা ছাড়ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্রমজীবী মানুষরা। অধিকাংশই কর্মের তাগিদে এলাকা ত্যাগ করছেন। আবার অনেকে করোনার ভারতীয় ধরন আতঙ্কে। এতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

রোববার (৩০ মে) চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী প্রবেশের কয়েকটি চেকপোস্ট ও তারও সামনের কিছু সড়কে গিয়ে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লকডাউন উপেক্ষা করে ওই এলাকার মানুষ বাস, ট্রাক, কার-মাইক্রো, অটোরিকশা এমনকি গরুর গাড়িতে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করছেন। এমনকি অনককে রোগী সেজেও অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজশাহীর উদ্দেশে আসতে দেখা গেছে।

শুধু তাই নয়, চেকপোস্টের কয়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে রাজশাহী প্রবেশের কিছু কিছু ছোট রাস্তা। অনেকে অটোরিকশা কিংবা মোটরসাইকেলযোগে সেসব রাস্তা দিয়ে রাজশাহী ঢুকছেন। এতে সহজেই ফাঁকি দিতে পারছেন প্রশাসনের চোখও।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খলিলুর রহমান পাটোয়ারী জানান, বালিয়াঘাটা, সুলতানগঞ্জ ও জৈট বটতলা নামের তিনটি পয়েন্টে রাজশাহীর প্রবেশ পথে চেকপোস্ট রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আগতদের সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রাজশাহী প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

তিনি আরও জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি চরাঞ্চল এলাকা হচ্ছে অনুপনগর। অনেকে হেঁটে হেঁটে সেই চরাঞ্চল পাড়ি দিয়ে রাজশাহী ঢুকছেন। আবার অনেকে নৌপথে ঢুকছেন। দুই জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা রাজশাহীর গোদাগাড়ী। এই অঞ্চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষার সঙ্গে রয়েছে বেশ মিল। তাই অনেকেই গোদাগাড়ী অঞ্চলের মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের প্রতিদিনই করোনায় মারা যাচ্ছে রোগী। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের। গত ২৫ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত এই জেলার ১৫ জনের শরীরে করোনার ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে। দিন দিন বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও। ফলে ২৪ মে থেকে সেখানে বিশেষ লকডাউন চলছে।

এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের পরিচয় গোপন করে অন্য জেলায় যাচ্ছেন। জীবিকার তাগিদে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার জন্য রাজশাহীর রেল ও বাস স্টেশনে আসা এমন বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যাদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আলাপচারিতার সময় শুরুতে নিজেদের ঠিকানা রাজশাহীর গোদাগাড়ী বললেও পরে প্রকৃত ঠিকানা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বলে নিশ্চিত করেছেন তারা। আবার অনেকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় স্থান ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র।

রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজশাহীর শিরোইল বাস টার্মিনাল ও রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, কারও মাথার নিচে ব্যাগ, কেউ মোবাইল নিয়ে করছেন ফেসবুকিং আবার অনেকেই মোবাইলে সাপ-লুডু খেলে সময় পার করছেন। কেউ আবার আধশোয়া অবস্থায়। গরমের মধ্যে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। তাদের সবাই নির্মাণ শ্রমিক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। বিকল্প পথে রাজশাহীতে এসেছেন বলে জানান তারা।

রাজশাহী স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ড চত্বরে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মাসুদ রানাসহ কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক এসে নামেন। রাস্তার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাসুদ রানা জানান, তার বাড়ি গোদাগাড়ী, যাবেন ঢাকায়। তবে রাস্তায় আসার পথে অনেকগুলো চেকপোস্ট পার হতে হয় তাদের। গোদাগাড়ী বাড়ি বলায় ছেড়ে দেয়া হয় চেকপোস্ট থেকে।

অটোরিকশা থেকে নামেন রবিউল ও তার এক আত্মীয়। তারা জানান, এসেছেন কাকনহাট থেকে। যাবেন পাবনা জেলায়। তবে কিছুদূরে গিয়ে তিনি মিলিত হন চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার একটি নির্মাণ শ্রমিক গ্রুপের সঙ্গে।

স্টেশনের একটি বটগাছের নিচে শুয়ে ছিলেন কয়েকজন। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সবাই গোদাগাড়ীর কথা বলেন। গ্রামের নাম জানতে চাইলেও গোদাগাড়ীর কথা বলেন। একপর্যায়ে আর কোনো কথা না বলে সেখান থেকে সরে যান সবাই।

স্টেশনের প্রবেশ পথেই রয়েছে স্টিলের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এতে প্রায় আট ৮-১০টি ব্যাগ ঝোলানো রয়েছে। এর পাশে আইল্যান্ডে বসেছিলেন দুই যুবক। তাদের পাশেই রাখা ছিল রাজমিস্ত্রির কাজে ব্যবহৃত দুটি লাঠি। আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে মোবাইল দেখে সময় পার করছিলেন। কাছে গিয়ে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেই, আমতা আমতা করে কিছুক্ষণ পর একজন মুচকি হেসে বলেন- আমার নাম রুবেল (২৩)। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলেন, সুইচগেট। তবে কোন জেলা বা উপজেলায় তা বলেননি। তার সঙ্গে ৭-৮ জন আছেন বলেও জানান।

স্টেশনের গণসৌচাগারের পাশের বটগাছের নিচে সাতজনের একটি দল বসেছিলেন। এই দলের ইসমাইল হোসেন (৩২) নামের এক যুবক যাচ্ছেন নোয়াখালীতে। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাখোরালী গ্রামে। তিনি জানান, দিবাগত রাত ৩টার দিকে বাড়ি থেকে বের হন। অটোরিকশায় ভোর ৫টায় রাজশাহীতে পৌঁছান।

এই দলের কাছে একা বসেছিলেন শরীফুল ইসলাম। তিনিও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে আসেন ঢাকায় যাওয়ার জন্য।

এদিকে, স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত যাত্রীর মধ্যে ছিল না সামাজিক দূরত্ব। মাস্কও ছিল না কারও কারও মুখে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে তেমন নজরদারিও দেখা যায়নি।

তবে স্টেশনের প্রবেশ পথে রেলওয়ের পক্ষ থেকে একব্যক্তি মাইকিং করে বিনা টিকিটে স্টেশনে প্রবেশ করা যাবে না বলে সর্তক বার্তা দেন। এছাড়াও তিনি মাইকিং করে জানান, সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। কাউন্টারে কোনো টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। যাদের কাছে টিকিট নেই তারা যেন স্টেশন চত্বর ছেড়ে দ্রুত অন্যত্র চলে যান।

কাশিয়াডাঙ্গা চেকপোস্টে দায়িত্বরত সার্জেন্ট সন্দ্বীপ কুমারের কাছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা এখানে ইন ও আউট চেকপোস্টের দ্বারা পুলিশের পক্ষ থেকে মনিটরিং চলছে। এছাড়া এনআইড কার্ড চেক করে দেখা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাউকে পেলে তাদের মামলা দিয়ে অথবা উল্টোপথে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া কেউ কার, মাইক্রো এমনকি সিএনজিতে গেলে তা থামিয়ে কারণ জানা হচ্ছে।’

পাশেই চেকপোস্ট মনিটরিংয়ে এসেছিলেন কাশিয়াডাঙ্গা থানার ডিসি মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাজশাহীতে যেখানে দুটি টিম ছিল চেকপোস্টে সেখানে আমরা তিনটি টিম তৈরি করে কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছি। এছাড়া রাজশাহী প্রবেশের জন্য যেসব গাড়ি আসছে তাদের প্রত্যেকের এনআইডি ও আইডি কার্ড চেক করছি। কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফিরতে চাইলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের আবার ফেরত পাঠাচ্ছি। এমনকি কর্মকর্তারাও মাঠ পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টা বিভিন্নভাবে মনিটরিং করছি, যাতে চাঁপাই থেকে কেউ যেন না প্রবেশ করতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর টিমের যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বয় রক্ষা করে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া যেসব ছোট-খাট রাস্তাগুলো দিয়ে বাইপাস করতে পারে বলে মনে হচ্ছে সেখানেও আমরা সাময়িক চেকপোস্ট বসাচ্ছি এবং আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম ইয়াজদানি জানান, শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাতজনের শরীরে করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউই ভারতে যাননি। সেই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে লকডাউন কড়াকড়ি করার দাবি জানান। একইসঙ্গে রাজশাহীতেও বিশেষ লকডাউন ঘোষণার প্রস্তাব জানান।

সূত্র: জাগো নিউজ ২৪



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top